আমাদের দেশে ক্ষতিপূরণ বিধানগুলো মূলত সিভিল ক্ষতিপূরণ। তবে ক্রিমিনাল ক্ষতিপূরণের একটা বিধান এখনো ঝুলে আছে খসড়া হয়ে, অনুমোদনের অপেক্ষায়। সেটারও প্রায় ১৪ বছর হয়ে গেলো!
Crime victims’ Compensation Act -2007 নামের এই আইন এখনো আতুঁড়ঘরেই রয়ে গিয়েছে।
শুরুতেই একটা অকারেন্স মনে করিয়ে দেই আপনাদের। রূপা খাতুন গ্যাং রেপটার কথা মনে আছে? ঐ যে টাঙ্গাইল -ময়মনসিংহ হাইওয়েতে বাসে ঘটে যাওয়া সেই ন্যাক্কারজনক রেপ ঘটনাটি। মধুপুর ফরেস্ট রেঞ্জ এলাকাতে লাশ ফেলে গিয়েছিলো দুষ্কৃতিকারীরা, রেপের পরে।
আদালত দুইটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন এই মামলায়। এক হলো, ১৪ দিনের ভেতরেই আদালত রায় শুনিয়েছিলেন।
আর দুই নাম্বার হলো, আদালত বলেছিলেন, যে বাসটিতে রেপের ঘটনা ঘটেছিলো সে বাসটি ক্ষতিপূরণ হিসেবে রূপার পরিবারকে হস্তান্তরের জন্য।
এমনিতে আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন -২০০০ এ জরিমানা করার বিধান রয়েছে এবং এই সংক্রান্ত অধিকাংশ মামলাতেই শাস্তির সাথে জরিমানাও আরোপ করা হয়।
প্রশ্নটা হলো, এই জরিমানাকে কি ক্ষতিপূরন হিসেবে রূপ দেয়ার সুযোগ আছে কিনা?
ব্লাস্টের করা এক গবেষণা জরিপে দেখা যায়, আদালত ৪৪ টা মামলার ( দৈবচয়ন) ক্ষেত্রে মাত্র ৩ টি মামলায় জরিমানাকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। তার মধ্যে আবার দুটি মামলায় আসামীরা উচ্চ আদালতে খালাস পেয়েছেন। তার মানে মুলত ১ টি মামলাতেই জরিমানাকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে রূপ দেয়ার নজির আছে এবং সেটা ঐ রূপা খাতুনের মামলাটাই।
আর জরিমানাকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে রূপ দেয়ার বিষয়টা মূলত আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতা, এটা এখনো বাধ্যতামূলক নয়। আর এখানেই আসলে ভিক্টিমের ক্ষতিপূরণ আইনের প্রাসঙ্গিকতা উঠে আসে। রেপ ভিক্টিমের ক্ষেত্রে সচরাচর ১০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা দেয়া হয়। এই জরিমানা মূলত রাষ্ট্রের কাছেই যায়।
পাঁচ বছর বয়সী সেই শিশু ধর্ষনের ঘটনাটা মনে আছে নিশ্চয়ই। ২০১৬ সালের ঘটনা। দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার। নিজের বন্ধুর বাবা কর্তৃক ধর্ষিত হয় এই শিশু। ছয় বছর মামলা চলার পর সম্প্রতি যাবজ্জীবনের রায় হয়। সাথে ২০ হাজার টাকা জরিমানা। এমনিতেই দিনমজুর পরিবার, তার উপর শিশুটির মানসিক অবস্থাও বেশ খারাপ। তার ব্লাডারের এমন অবস্থা হয়েছে যে প্রতি দশ মিনিটেই তার প্যান্ট বদলাতে হয়। সমস্যাটা তখনই দেখা দেয়, যখন দেখা যায় অভিযুক্ত নিজেই দিনমজুর লেভেলের লোক। তার পক্ষে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতিপূরণ দেয়া সম্ভব না। আর জেলে থাকলে ক্ষতিপূরনের টাকা জোগানোও অসম্ভব। জায়গা-সম্পত্তি হয়তো বাজেয়াপ্ত করা যায়, তাও তো ঐ রাষ্ট্রের অনুকূলে ন্যস্ত এবং অতি অবশ্যই আমলাতান্ত্রিকতায় ঘেরা। এখানেই স্টেট মেকানিজমের গুরুত্ব। এখানেই রাষ্ট্রের দায় দায়িত্ব। এখানেই ক্ষতিপূরণ আইনটির প্রাসঙ্গিকতা। কারণ, রূপা খাতুনের ঘটনার মত সবখানেই তো vicarious liability দিয়ে মালিককে দোষী সাব্যস্ত করার সুযোগ নেই। ( ঐ ঘটনায় বাস মালিকের বাসটি ভিকারিয়াস লায়াবিলিটির আওতায় রূপার পরিবারকে দেয়া হয়) ।
বিষয় আরো আছে, এই যে বছরের পর বছর ধরে মামলা চলছে, কোন সুরাহা আসছে না। কিন্তু ভিক্টিমের চিকিৎসা তো বন্ধ নেই। চিকিৎসার খরচটাই বা কোথা থেকে আসবে? বিচারের পর গিয়ে যদি আসামী খালাস পেয়ে যান, ভিক্টিম বা তার পরিবারের অবস্থাটা কি হবে? ভারতীয় লিগাল মেকানিজম কিন্তু এদিক থেকে বেশ এগিয়েছে। তাদের সিআরপিসি ৩৫৭A ধারানুযায়ী ভিক্টিমের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পথ তৈরি করা হয়েছে( মালিমাথ কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী)। ঐ ধারায় একটা কম্পেনসেশন স্কিম তৈরীর কথা বলা হয়েছে যেটা প্রাদেশিক ও কেন্দ্র সরকার মিলে তৈরী করবে। এমনকি যেখানে অপরাধীকে ট্রেস করা যায়না, সেক্ষেত্রেও ভিক্টিম ক্ষতিপূরণের জন্য ঐ স্কিম থেকে আবেদন করতে পারবেন। এমনকি তাদের উচ্চ আদালতের বেশ কিছু রুলিং আছে ( রূদুল শাহ বনাম বিহার) যেখানে এমনটাও বলা হয়েছে, যে ক্ষতিপূরণ পাবার অধিকার সংবিধানের রাইট টু লাইফকে সরাসরি সমর্থন করে। তাদের সংবিধানের রাইট টু লাইফের যে মুল বাণী তার সাথে আমাদের সংবিধানের রাইট টু লাইফ অনুচ্ছেদের মুল উদ্দেশ্য একই রকম বলতে গেলে। উদ্দেশ্যের দিক থেকে কোন পার্থক্যই নেই।
বাংলাদেশ ICCPR এর সিগনেটরি রাষ্ট্র। মানুষের মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করার বিধান এই কনভেনশনে আছে। ভিক্টিমের Reparation টা অবশ্যই তার মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিতের জন্য দরকার।
আদালত অনেক ক্ষেত্রেই চাইলেই পারেন না জরিমানাকে ক্ষতিপূরণে রূপ দিতে। অনেক সীমাবদ্ধতা কাজ করে। বিধিবদ্ধ আইন থাকলে কাজটা সহজ হয়। আর এই দেশে ধর্ষণ মামলাগুলোর ক্ষেত্রে কনভিকশন রেটই মাত্র ৩% ; এটা অবশ্য ঠিক যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সহ অন্যান্য পেনাল আইন সমূহের যথেচ্ছ ব্যবহারও আছে। তবে, সেক্ষেত্রে মিথ্যা মামলার বিরূদ্ধে অভিযোগ দায়েরর বিধানও আছে।
শুধু ধর্ষণ মামলা বলেই নয়, সমাজের আরো বহু অপরাধ আছে, যেখানে ভিক্টিমের রাইট টু লাইফের অধিকার খর্ব হয়। আর তাই ক্ষতিপূরণের একটা বিধিবদ্ধ পূর্ণাঙ্গ আইন দরকার। দেশীয় কিছু আইনে যদিও ভিক্টিমদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ আছে, যেমন মানব পাচার প্রতিরোধ আইন, হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন বা সিআরপিসির ৫৪৫ ধারা ইত্যাদি। তবে ভিক্টিমের পারিপাশ্বির্ক অবস্থা বিবেচনায় তা নেহাতই কম।
সমস্যা হলো খালাস পেয়ে যাওয়ার পর ক্ষতিপূরণ দিতে কাউকে বাধ্য করা যায় না। বিষয়টা এমন যে, অপরাধী খালাস পেয়ে গেলেও যেহেতু অপরাধ ঘটেছে ভিক্টিম তো একজন আছেই। পাশের ভারতের ভিক্টিম কমপেনসেশন স্কিম যেমন এক্ষেত্রে একটা Landmark দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।