নিউজিল্যান্ডের ওয়ানগানুই নদী বা ভারতের গঙ্গা, চাইলে আরো দুই/একটা বিষয়ে উদাহরণ টানা যাবে।
তবে বাংলাদেশে যেটা হয়েছে সেটা নজীরবিহীণ। তুরাগ নদীসহ দেশের সব নদীকে legal personhood দিয়েছে এদেশের উচ্চ আদালত।( বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও আশরাফুল কামালের দ্বৈত বেঞ্চ)। অন্যান্য দেশে দুই একটা নদীকে হয়তো তেমন আইনী সত্তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সমস্ত নদীকেই legal personhood দেয়া হয়েছে। মানে হলো, নদী চাইলে এখন থেকে নদীর কোন দূষণ, দখল এগুলোর বিরূদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে, আদালতে।
না, নদীর তো আর সশরীরে আসার সুযোগ নেই, সেটা সম্ভবও না। তাই জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের হাতেই এই ক্ষমতা ন্যস্ত।
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার আগে আমাদের দেশের Environmental legal regime নিয়ে একটু কথা বলা প্রাসঙ্গিক। দেশে কম করে হলেও পরিবেশ সংক্রান্ত ২০০ আইন রয়েছে। আর পরিবেশ আদালত আইন ২০০০ এর অধীনে পরিবেশ আদালতও আছে। আর এই পরিবেশ আাদালতে ঐ ২০০ আইনের মধ্যে কেবল দুইটি আইনের অধীনে সংগঠিত অপরাধ আমলে নেয়ার ক্ষমতা আছে ; পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ ও ইট ভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৩ হলো সেই দুইটি আইন।
পরিবেশ আদালতে সাধারণ মানুষের মামলা করার ক্ষমতাও খুব সীমিত। ক্ষতিপূরণের জন্য মামলা করার সুযোগ যদিও আছে।
বিদ্যমান আইনে যদিও নদী দূষণের বিরূদ্ধে মামলা করার সুযোগ আছে ( পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, প্রাকৃতিক জলাধার আইন, পানি আইন ইত্যাদি), তবে এসব বিষয়ে মামলা খুব একটা হয়েছে তেমন নজীর আসলেই নেই।
নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩ নামে একটা আইন আছে যেটা অনেকটা না থাকার মত করেই আছে। নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০২০ খসড়া হয়ে ঝুলে আছে অনেকদিন যাবত।
আমাদের হাইকোর্ট যখন তুরাগ নদী সহ দেশের সকল নদীর উপর আইনী সত্তা ন্যস্ত করেন তখনই নদী রক্ষা কমিশনের প্যারেন্টাল রাইট বা অভিভাবকত্ব ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। মানে নদীর অভিভাবক নদী রক্ষা কমিশন। এই রায়ের আলোকে সংশোধিত আইনটির খসড়া হওয়া শুরু হয়।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা এই রায়ে প্রতিফলিত হয়।
প্রথমত যেটা উঠে আসে, সেটা হলো পাবলিক ট্রাস্ট ডকট্রিন ( public trust doctrine)। এই ডকট্রিনের আলোচ্য বিষয় হলো কিছু প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদ জনগণের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করে যেতে হবে। যেটা আমাদের সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদেও উঠে এসেছে। আবার এই মতবাদ অনুযায়ী প্রাকৃতিক সম্পদ আসলে জনগনেরই সম্পদ। এই সম্পদের ক্ষতি হলে ৩১ অনুচ্ছেদ এর বিধান মতে, অনুচ্ছেদ ১০২(১) অনুযায়ী উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগও আছে।
রায়ে নদীর জীবনীসত্তা ঘোষণার পেছনের কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে বেঞ্চ কুরআনের রেফারেন্স টেনে বলেছেন, ‘ প্রাণবন্ত সবকিছুই পানি থেকেই তৈরী করা হয়েছে।
আদালত তার রায়ে আক্ষেপ করে বলেছেন, পাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তি রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘ ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ ঘোষণা করলেও প্রধানমন্ত্রীর সব কর্মপ্রচেষ্টা ম্লান হয়ে যাচ্ছে দেশবিরোধী গুটিকয়েক অবৈধ দূষণকারী, দখলদার ও তাদের সহযোগী হাতেগোনা কিছু জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জন্য।
২৮৩ পৃষ্ঠার এই রায়ে পাবলিক ট্রাস্ট ডকট্রিনের উপর বিশদ পর্যবেক্ষণ রয়েছে। এছাড়াও আদালত রায়ে এটাও উল্লেখ করেছেন, অনাদিকাল থেকেই মানবসভ্যতা নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। নদী হত্যা তাই আমাদের আত্মহত্যারই নামান্তর।
এই রায়ের আলোকে নদী রক্ষা কমিশনের যে খসড়া আইনটি হয়েছে তাতে দেশের সব জেলায় ‘নদী রক্ষা আদালত ‘ প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়েছে। সেটি হলে নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে। নদী দূষণ বিষয়ে হাইকোর্টে যাতে বারংবার না আসা লাগে সেটা নিশ্চিত করতেই সমস্ত নদীর উপরই আইনী সত্তা ন্যস্ত করা হয়েছে এবং আইন আধুনিকীকরণের কথা বলা হয়েছে। মুলত রীটটি আইনজীবী মনজিল মোরশেদ করেছিলেন তুরাগ নদীকে কেন্দ্র করে। আদালতে যাতে অন্যান্য নদীর আইনী সত্তা ঘোষণা নিয়ে বারবার না আসা লাগে তার জন্য আদালত সমস্ত নদীর উপরেই এই সত্তা ন্যস্ত করেছেন। সমস্ত নদীই আমাদের অস্তিত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
একটা বিখ্যাত কেস রেফারেন্স এবার বলি। Taizhou pollution case. নদী দূষণের উপর এরচেয়ে বড় ক্ষতিপূরণ মামলা দুনিয়ায় আর নাই। প্রায় ২৬ মিলিয়ন ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছিলেন চাইনিজ কোর্ট। দূষণের জন্য যে দায়ী, তাকেই ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। আইনে এটাকে polluters pay principle. ৬ টা কর্পোরেশনকে দায়ী করা হয়েছিলো যারা নদীদূষণে সরাসরি দায়ী ছিলো। রুটাই খাল এবং গুগামান নদীতে প্রায় ২৬০০০ টন এসিড বর্জ্য এই ৬ টি কর্পোরেশন ডাম্প করেছিলো। ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে আদালত virtual remediation cost মেথড প্রয়োগ করেছিলো। মানে বৈধ উপায়ে বর্জ্য অপসারণে যা খরচ হতো তাই ক্ষতিপূরণ হিসেবে নির্ধারিত। আর মামলা করেছিলো একটা পরিবেশবাদী সংগঠন, যাদের locus standi ছিলো। অনেকটা আমাদের বেলা ( BELA) বা পবা( পরিবেশ বাঁচাও) ‘র মত।
বাংলাদেশে নদী দূষণ ও দখলে কি পরিমাণ নদীপথ ম্যাপ থেকে মুছে গেছে তার হিসাব খোদ নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট এরই নেই। কিন্তু এসব ঘটনার পেছনে দায়ী অনুঘটকদের বের করার পথ অনেকটা সুগম হয়েছে আমাদের উচ্চ আদালতের এই রায়ের আলোকে। ৬৪ জেলাতে নদী দখলদারের সংখ্যা ৬৩ হাজার! নদী রক্ষা কমিশনই এই ডাটা দিয়েছেন। এই ৬৩ হাজার দখলদারদের কাছ থেকে কি পরিমাণ ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে? নদী তার গতিপথ হারিয়েছে, নাব্যতা হারিয়েছে,হারিয়েছে অস্তিত্ব। এর কোন প্রতিবিধান না হওয়াটা দুঃখজনক আসলেই। উপরের thaizhou pollution case এ ৬ টা কর্পোরেশন ২৬ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ যদি দেয়, ৬৩ হাজার দখলদার কী পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিবে?
বুড়িগঙ্গা দূষণের তালিকায় পুরো বিশ্বে দশটি নদীর একটি। এই নদীতে কোন পোকামাকড় ই নাকি বাঁচতে পারে না! দূষণ এই নদী ছাড়িয়ে শীতলক্ষ্যা -মেঘনাকেও গ্রাস করছে। ৭০০+ নদী কমে এখন ২৩০ এ এসে ঠেকেছে। পরিবেশের এই অমূল্য জিনিস, যার হকদার এদেশের মানুষ ( public trust doctrine মতে), তার যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে এসবের প্রতিবিধান নিশ্চিত করাটা এখন সময়ের দাবী।
Justice delayed, Justice denied! এখানে কিন্তু জাস্টিস পাওয়ার পথটাই এখনো উন্মোচন হয় নি। বিলম্ব তো বহুদূরের পথ।